Monthly Archives: নভেম্বর 2011

কৃষ্ণচূড়ায় সিক্ত

আদর্শ পোস্ট ফরম্যাট

বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের শাখা-প্রশাখার ফাঁকফোকর দিয়ে বাড়িটির অবয়ব যতটুকু দেখা যায় তাতেই যে কেউ বিমোহিত হয়ে যায়। কোন এক অদৃশ্য ভালোলাগা আর ভালোবাসার আবেশে মনটা ছুঁয়ে যায়। আশপাশের পুরনো সব বাড়িই আধুনিকতার দুঃসহ চাপে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু সব বাধাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে দু-তলা দালানের এ বাড়ি এখনো আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আধুনিকতার সব উপাদানকে তাচ্ছ্বিল্য করে বাড়িটি আপন গাম্ভির্য্য ও আপন আভিজাত্যে আজও মোহনীয়। সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত নকশা আঁকা প্রধান ফটক দেখলেই এর সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা পাওয়া যায়।

প্রায় তিন যুগ ধরে এ বাড়ির প্রধান কর্তা ত্রৈলোক্য চৌধুরী। এক পুত্র সন্তানের জনক চৌধুরীর স্ত্রী গত হয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। আত্নীয়-স্বজনদের অধিকাংশই পচাত্তর পরবর্তী সময়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর সাথে সাথে তারা নিজেদের জীবনকেও বিপন্নবোধ করেছিলেন, এদেশে থাকতে সাহস পাচ্ছিলেননা। শেখ সাহেব যেন তাদের সব ভরসা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ছোট ভাই দুটোও মাকে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমালো। কিন্তু ত্রৈলোক্য বাপ-দাদার ভিটে মাটির মায়া ছাড়তে পারলেন না। তিনি এবং তার স্ত্রী রয়ে গেলেন পূর্ব পুরুষদের জমিদারীর শেষ চিহ্ণ আগলে রাখতে।

ইস্পাত কঠিম মনোবলের অধিকারী ত্রৈলোক্য বাবুর শৈশব, কৈশোর, যৌবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে এই বাড়ির আঙ্গিনায়। আজ পঁয়ষট্টি বছর বয়সে এসেও সেই মায়া কাটাতে পারেননি। বরং সেই মায়া আরো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। আত্নীয়-স্বজনদের অনেকেই ভারতে চলে আসার তাগিদ দেন কিন্তু তিনি তার অনঢ় সিদ্ধান্ত থেকে একটুও নড়েননা।

ত্রৈলোক্য বাবু শারিরীক সমস্যাজনিত কারণে রিটায়ার্ড পিরিয়ডের অনেক আগেই চাকরি থেকে অবসর নেন। এলজিডিই ডিপার্টমেন্টের মত সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও তিনি সারাজীবন সৎভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন। প্রভিডেন্ট ফান্ড আর পৈত্রিক দোকানগুলো থেকে প্রাপ্ত টাকায় ভালোই চলে যাচ্ছে দিনকাল। ছেলে অভিজিত কানাডা থেকে টাকা পাঠাতে চাইলে তিনি না নিয়ে বলেন, এখানে যা পাচ্ছি তা দিয়েই তো চলে যাচ্ছে। তোমাদের ওখানে অনেক খরচ। তোমরা ভালভাবে থাকো।

ত্রৈলোক্য বাবুর দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটে উত্তরদিকের জুল-বারান্দায় ইজি চেয়ারে শুয়ে বসে। এ সময় তার একমাত্র সঙ্গী দৈনিক ইত্তেফাক আর প্রথম আলো। যৌবনে ইত্তেফাকের প্রতি তার যে ভালোবাসা জন্মেছিল সেই ভালোবাসা এখনও রয়ে গেছে। পত্রিকা ছাড়াও আছে বড় বড় তিনটি আলমিরা ভর্তি বই। পড়া বইগুলো ঘুরেফিরে পড়তে ভালোই লাগে তার। প্রতিদিন সন্ধায় একমাত্র নাতি প্রান্তের সাথে টেলিফোনে অনেকক্ষণ কথা বলেন। নাতির আধো মুখের বুলি শুনতে তার বেশ ভাল লাগে। পুরো কথা জুড়েই থাকে বাবা-মায়ের প্রতি প্রান্তের অভিযোগ। ত্রৈলোক্য শুনেন আর হাসেন।

পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের প্রায় সকলেই এই পাড়া থেকে উঠে গেছে। যে দু-একজন এখনও রয়ে গেছে তারাও জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে অবিরাম দুলছে। পাড়ায় নতুন যারা এসেছে তাদের সাথে তার খুব একটা খাতির নেই। বাড়িতে তার দেখাশোনার জন্য একমাত্র রয়েছে রমেশ। বাজার-হাট সব রমেশই করে। তিনি শুধু মাসের প্রথমে কাজীর হাটের ভাড়া দেয়া দোকানগুলো হতে ভাড়া তুলতে যান।

কাজীর হাটে যাওয়ার পথে এ পাড়ার ঠিক উলটো দিকে বড় রাস্তা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা বয়েজ স্কুলের দিকে চোখ পড়লেই মনটা কেমন জানি করে ওঠে ত্রৈলোক্যের। এই স্কুলে তার কত মজার স্মৃতি রয়েছে। সহপাঠিরা তাকে ত্রৈলোক্যের বদলে তেরলক্ষ বলে ভীষন খেপাত। প্রায়ই তিনি রেগে যেতেন আর সহপাঠিদের পিঠে দু-তিন ঘা বসিয়ে দিতেন। একবার তো জমসেদকে এমন ঘুসি দিয়েছিলেন যে বেচারার নাক দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়েছিল। তারপর হেডস্যার এসে যা পিটুনি দিয়েছিলেন তা ভাবতে এখনও গা শিউরে ওঠে ত্রৈলোক্যের। আজ এত বছর পর সেইসব কথা মনে পড়লে মনটা শূন্যতার অদৃশ্য প্রলেপে ঢাকা পড়ে।

এই বিশাল বাড়িতে ত্রৈলোক্য চৌধুরীর দুটো জিনিসকে খুব বেশী আপন মনে হয়। একটি সামনে উঠোনের সুউচ্চ কৃষ্ণচূড়া গাছ আর আরেকটি পেছনের বিরাটকার পুকুর। এ দুটোর প্রতি তার মনের মধ্যে অন্যরকম ভালোবাসা, অন্যরকম টান। সবাই তাকে ছেড়ে দূরে সরে গেছে কিন্তু এ দুটো এখনও তার সঙ্গী হয়ে রয়েছে। কৃষ্ণচূড়া আর পুকুরের দিকে চোখ পড়লেই তার শৈশব স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

শৈশবের সেই দিনগুলোতে কত সাঁতরেছেন এ পুকুরে। কতবার যে কৃষ্ণচূড়ার গাছের শীর্ষতে আরোহন করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। একবার তো পুকুরে সাঁতরাতে গিয়ে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন। একগলা পানি খেয়ে যখন একটু একটু করে নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছেন ঠিক তখনই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিনুদি। ত্রৈলোক্যকে পাঁজাকোলা করে তুলে আনেন ঘাটে। বিনুদির জলপাই রঙের শাড়িটা কাদা-জলে ভিজে তার শরীরের সাথে লেপ্টে ছিল। পাঁজাকোলা করে তুলে আনার সময় বিনুদির কোমল স্পর্শে ত্রৈলোক্য ভীষন রোমাঞ্চিত বোধ করছিলেন। বিনুদি পাড়ে উঠিয়ে ভীষন বকুনী দিলেন ত্রৈলোক্যকে। সেই বকুনী অমীয় সুধার মত কানে বাজছিল ত্রৈলোক্যের। বিনুদি সে দিন তার মমতা দিয়ে চৌদ্দ বছর বয়সের এক বালকের হৃদয়ে এক অনন্য স্থান অর্জন করেছিলেন।

ত্রৈলোক্যের চেয়ে সাড়ে তিন বছরের বড় বিনুদি ছিলেন সাদামাটা অথচ অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার মুখাবয়ব বিশেষ করে চোখের মধ্যে এমন এক মাধুর্য্য ছিল যা সহজেই যে কাউকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। তার স্নেহময়ী আচরণের কাছে ত্রৈলোক্য সম্পূর্ণ ধরাশায়ী হয়েছিলেন। বয়সের ফারাক থাকা সত্ত্বেও ত্রৈলোক্য বিনুদির প্রেমে পড়ে গেলেন। তখন বিনুদি পড়তেন উচ্চমাধ্যমিকে আর তিনি মাত্র ক্লাস এইটে। বিনুদি যখন চুলে রঙ্গীন ফিতে বেঁধে বেণী দুলিয়ে কলেজে যেতেন তখন ত্রৈলোক্য এতোটাই মুগ্ধ হয়ে দেখতেন যে তখন দুজনের মধ্যকার বয়সের পার্থক্য মনে থাকতোনা। পৌষ সংক্রান্তির সময় মেশোমশাই যখন বিনুদিকে বাড়ি নিয়ে যেতেন তখন ভীষন মন খারাপ হত ত্রৈলোক্যের। তখন তিনি গণিত খাতায় সম্পাদ্য আঁকার বদলে ছবি এঁকে যেতেন। সেই ছবিতে মেশোমশাইকে দেখা যেত দস্যুরূপে যে আরেকজনের মনের মানুষকে ছিনিয়ে নিচ্ছে!

কিন্তু সেই বিনুদি যখন কমলদার হাত ধরে এক লক্ষীপুজোর সন্ধ্যায় অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন তখন ত্রৈলোক্য অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। এক আকাশ শ্রাবণধারা অঝোরে নেমেছিল তার দু-চোখ বেয়ে। তার হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করার কোন সুযোগই দিলেন না বিনুদি। এর অনেকদিন পর তিনি খবর পেয়েছিলেন, এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বিনুদি গলায় দড়ি দিয়ে আত্নহত্যা করেছেন। বিনুদির মৃত্যুর খবর শুনে ত্রৈলোক্য ভীষন ব্যাথিত হয়েছিলেন। সেই থেকে প্রতি ফাল্গুনী পূর্ণিমায় তিনি বাড়ির পেছনের পুকুরে কৃষ্ণচূড়া ভাসিয়ে দেন বিনুদির প্রতি ভালবাসার নিদর্শনস্বরূপ।

বিনুদি ছাড়াও আরেকজনের প্রেমে পড়েছিলেন ত্রৈলোক্যবাবু। মুক্তিযুদ্ধের বছর তিনেক আগে কলকাতা থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে পূর্বপাকিস্তানে ফিরে এলেন ত্রৈলোক্য। বড় পিসি কিছুতেই আসতে দিচ্ছিলেন না। কিন্তু ত্রৈলোক্য জেদ ধরলেন তিনি দেশে এসেই বাকি পড়াশোনা করবেন। শেষ পর্যন্ত বড়পিসি তাকে পাঠিয়ে দিলেন পূর্ববঙ্গে। বাড়িতে ঢুকার পথেই দেখতে পেলেন, কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সদ্য কৈশোর পেরুনো এক যুবতী ফুল কুড়োচ্ছে। উঠোন ধরে বাড়ির দিকে হাটা ধরতেই মেয়েটির সাথে ত্রৈলোক্যের চোখাচোখি হলো। মেয়েটা লাজুক ভঙ্গিতে চোখ সরিয়ে নিল। ক্রমাগত যৌবনের পথে অগ্রসরমান এই তরুণীর দৃষ্টিবাণে ত্রৈলোক্য বিদ্ধ হলেন। এক অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করেছিল তার মধ্যে। পরে তিনি জানতে পেরেছিলেন এই তরুণী তার ছোট কাকীর বোনের মেয়ে।

দুজনের মধ্যে ভাব জমতে খুব একটা সময় লাগেনি। ত্রৈলোক্য ও কাজলরেখার মধ্যে অনেক ভাল বন্ধুত্ব তৈরী হয়ে গিয়েছিল। কাজলরেখা যে কয়দিন তাদের বাড়িতে ছিল খুব ভাল সময় কেটেছিল ত্রৈলোক্যের। যেদিন কাজলরেখা তার বাবার সাথে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল সেদিন কাজলরেখা খুব কেঁদেছিল আর বারবার ত্রৈলোক্যের দিকে তাকাচ্ছিল। ত্রৈলোক্যের মনটাও কেমন জানি করছিল। বিনুদির পর এই প্রথম কোন মেয়ের প্রতি তিনি নিজের মধ্যে ভাললাগার আবেশ অনুভব করছিলেন।

কাজলরেখা চলে যাওয়ার পরেও অনেকদিন যোগাযোগ ছিল পত্রের মাধ্যমে। তারা উভয়েই নিজেদের মধ্যে পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। প্রতি বসন্তে ত্রৈলোক্য রঙ্গীন খামে করে পাঠাতেন কৃষ্ণচূড়ার শুকনো পাঁপড়ি। আর ফিরতি চিঠিতে কাজলরেখা হৃদয় নিংড়ানো আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে লিখত মনের ভাললাগা। এমনি এক বসন্তে পাঠানো চিঠির কোন জবাব এলোনা। এর কিছুদিন পর জানতে পারলেন কাজলরেখার বিয়ে হয়ে গেছে এক মস্তবড় ব্যবসায়ীর সাথে। ত্রৈলোক্যের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। জীবনের দুটো ভাললাগাই এভাবে দূরে হারিয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে।

তারপর পচাত্তরের এক ফেব্রুয়ারীতে ত্রৈলোক্যের বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার ইচ্ছে মারা যাওয়ার আগে বড়ছেলের বউ দেখে যাবেন। তাই একান্ত অনিচ্ছ্বা সত্ত্বেও বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হলেন। বাসর রাতে বাইরে বইছিল উত্তাল হাওয়া যেন একটু পরই ঝড় আসবে। সেই রাতে নতুন বউয়ের ঘোমটা দূরে সরিয়ে ত্রৈলোক্য প্রথম কথাটি বলেছিলেন, এ বাড়িতে তোমার একটা সতীন আছে।
বিয়ের প্রথম রাত্রেই স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে জয়িতা আৎকে উঠেছিলেন। আবছা আলোতেও বোঝা যাচ্ছিল জয়িতার চোখ দুটি ছলছল করছে। ত্রৈলোক্য জানালার পর্দা সরিয়ে ঈশারায় দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছটিকে দেখান। কালবৈশাখীর উম্মাতাল হাওয়ায় তখন কৃষ্ণচূড়া গাছটি ভীষন নাচানাচি করছিল। মূহুর্ত্বেই জয়িতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সব ভয় কেটে যায়। নববধুর স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে ত্রৈলোক্য হারিয়ে যান গহীন সমুদ্রে। বিনুদি আর কাজলরেখাকে ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন একজন জয়িতার প্রাণপুরুষ।