সিক্ত প্রণয়

আদর্শ পোস্ট ফরম্যাট

পরপর ম্যাচের পাঁচটা কাঠি নষ্ট করলো রাহাত। সিগারেট জ্বালাতে গেলেই কোথা থেকে একঝাঁক শীতল হাওয়া এসে আগুন নিভিয়ে দিচ্ছে। এই শীতল বাতাসে বেশ তীক্ষ্ণতা আছে, বয়ে যাওয়ার সময় সমস্ত গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে যায়। নভেম্বরের প্রথম দিকেই এমন শীতল হাওয়া জানান দিচ্ছে গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার শীত বেশ ঝাঁকিয়েই পড়বে। রাহাত বেলকনিতে ঝুলানো দড়ি থেকে একটা তোয়ালে জড়িয়ে নিল শরীরে। শেষ পর্যন্ত বাইরের দিকে পেছন ফিরে অনেক কষ্টে সিগারেট ধরায়। লম্বা দম নিয়ে অনেকখানি ধোঁয়া গলধঃকরণ করে বেশ খানিকক্ষণ পর ঘাড় উচু করে ধীরে ধীরে সব ধোঁয়া শূন্যে ছড়িয়ে দিয়ে একটি শান্তির নিশ্বাস ছাড়ে। সিগারেটের ধোঁয়া একটি বৃত্তাকার কুন্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে এক পাক ঘুরে বেলকনির গ্রীল দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাতের খাবারের পর আয়েশ করে সিগারেট খাওয়া রাহাতের পুরনো অভ্যেস। সিগারেটে টানের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে দুনিয়ার সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার খাচ্ছে।

সিগারেট যখন প্রায় শেষ হবে ঠিক তখনই পাশের বিল্ডিং এর বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো একটি মেয়ে। রাহাত কিছুটা অবাক হলো কেননা গত ছয় মাসে একবারও ওই বাসায় কোন মেয়েকে সে দেখেনি। অমাবস্যার রাত বিধায় মেয়েটির চেহারা ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা। শুধু ওপাশের বেলকনির দেয়ালে দেখা যাচ্ছে একগুচ্ছ চুলের ছায়া। রাহাতের অল্প অল্প ভয় লাগলো, ভুত-টুত নয়তো! মেয়েটি গ্রীলের সামনে এসে বলল, আপনার কি সিগারেট খাওয়ার আর কোন জায়গা নেই! সিগারেটের গন্ধে ঘরে বসা যাচ্ছেনা। প্লীজ একটু সরে অন্য কোথাও গিয়ে সিগারেটটি খান। মেয়েটি অস্বাভাবিক দ্রুততায় কথাগুলো বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো।
দরজা লাগানোর ভঙ্গিতে এতোটাই তাচ্ছ্বিল্য ছিল যে, রাহাত ভীষণ অপমানিতবোধ করলো। তবে মেয়েটি ভুত নয় নিশ্চিত হয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। শার্টের বোতাম ফাঁক করে খানিকটা থু-থু ছিটিয়ে দিলো বুকের মধ্যে। মেয়েটির কথার ধরনে একরাশ রাগ মিশে থাকলেও, বেশ একটা মিষ্টতা ছিলো উচ্চারণ ভঙ্গিতে।

রাহাতের ভীষন রাগ হচ্ছিলো মেয়েটির ওপর। সে তার নিজের বাসায় সিগারেট খাচ্ছে তাতে ওই মেয়েটির কি? সে নিজেকে সংযত করে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পায়ের তলায় পিষ্ট করে নিলো। এমনিতেই ঢাকা শহর তার কাছে বিরাট অপছন্দের। শুধুমাত্র বড় ভাইয়ার ইচ্ছেতেই সে চট্রগ্রাম ছেড়ে ঢাকাতে এসেছে। আজ আরেকটু বেশী রাগ হলো ঢাকা শহরের উপর। এই শহরের বাসাগুলো এমনভাবে একটার সাথে আরেকটা বানানো হয়েছে যে নিজের ইচ্ছে স্বাধীনমতো কিছু করতে গেলেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় পাশের ফ্ল্যাট অথবা বিল্ডিং এর বাসিন্দা।

রাগে গজগজ করতে করতে রাহাত ঘরে ঢুকল। ল্যাপটপ অন করে শ্রীকান্তের গাওয়া একটি আধুনিক গান ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। রাহাত শ্রীকান্তের গাওয়া গানের ভীষন রকমের ভক্ত । শ্রীকান্তের কন্ঠে গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত তার সবচেয়ে প্রিয়। তার কাছে মনে হয় রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার পরে রবীন্দ্রসংগীতে শ্রীকান্তই সেরা।

সারা ঘরময় বেজে চলেছে শ্রীকান্তের গাওয়া একটি আধুনিক গান,

তোমাকে বলার ছিল,
যত আমি গান গাই;
যত গান গেয়ে যাই,
সব গানে সব সুরে;
তোমাকে বলার ছিল,
ভালবাসি।

সুমধুর গানের সাথে সাথে পুরো ঘর যেন সুগন্ধে ভরে গেছে! সুমিষ্ট কন্ঠের গানগুলোর মধ্যেই যেন সুগন্ধ মিশানো থাকে। মিউজিক প্লেয়ার অন করে দিলেই সারা ঘর ফুলের সুভাষে মোহিত হয়ে ওঠে। গান শুনতে শুনতে ঘুমের জগতে হারিয়ে যায় রাহাত।

ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখনো বেশ সকাল। হালকা কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে চারপাশ। উঠি উঠি করেও সুর্য্যিমামা উঠছেনা। সাইবেরিয়ার শীতল হাওয়া এবার সময়ের অনেক আগে চলে আসায় এই অবস্থা। রাহাত আড়মোড়া ভেঙ্গে অলসভঙ্গীতে ব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে, শরীরে তোয়ালে জড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে এলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় কানে গুনগুন শব্দ ভেসে এলো। আরেকটু এগুতেই দেখতে পেলো পাশের বিল্ডিং এ একটি মেয়ে গভীর মনোযোগের সাথে ফুলগাছে পানি দিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। দুটো বিল্ডিং এর মধ্যে দুরত্ব মাত্র দেড়হাত। রাহাত পানির ট্যাংকের আড়ালে থেকে মেয়েটিকে পরখ করে নিতে চেষ্টা করে। পাশ ফিরে থাকায় মেয়েটির মুখমন্ডল ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা। রাহাত ভালো করে লক্ষ্য করলো, মেয়েটির গায়ের রঙ বেশ ফর্সা, ঠিক যেন দুধে আলতা রাঙ্গানো। স্বাস্থ্যবতী না হলেও আকর্ষনীয় শারীরিক বাঁধন। গাল আর চিবুকের মাঝ বরাবর একটি ছোট্ট তিল রয়েছে যা মেয়েটির সৌন্দর্য্য অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

রাহাতের ইচ্ছে করছিলো সামনে এগিয়ে মেয়েটির সাথে কথা বলতে। কিন্তু গালভর্তি চার-পাঁচ দিনের বাসি দাড়ি নিয়ে সামনে যেতে সংকোচ বোধ করছিলো। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে সে ট্যাংকের নল থেকে পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সে ছাদের রেলিং এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটি রাহাতের দিকে একবার তাঁকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। পুরো মুখমন্ডল দেখে রাহাত সম্পূর্ণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। চেহারাটি তার অনেক পরিচিত, অনেক আপন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ছিলোনা।

রাহাত ভীষণ আড়ষ্টতার সাথে ডাকলো, এই যে শুনছেন।
মেয়েটি রাহাতের দিকে আড়চোখে চেয়ে বললো, আপনি কি আমাকে বলছেন?
জ্বি আপনাকেই বলছি। কথাটি বলে রাহাত মৃদু হেসে নেয়।
হুম! তা কি বলতে চান আমাকে? মেয়েটি বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো।
রাহাতের গলার স্বর আটকে যাচ্ছিলো। সে প্রায় থোতলিয়ে বললো, আমি রাহাত।
বুঝলাম আপনি রাহাত! কিন্তু আপনার নাম দিয়ে আমি কি করবো? বিরক্তির স্বরে মেয়েটি বলে।

রাহাত কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। তার বুক টিপটিপ করছে। এই মেয়েটির চেহারা ঠিক সাদিয়ার মতো। সে নিজেকে ধিক্কার দিলো! সাদিয়ার চেহারা চিনতে তার এতোক্ষণ সময় লাগলো! মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সে সাদিয়ার চেহারা ভুলে গেলো! সাদিয়া যেমন করে কথা বলতো, এ ও সেই ভঙ্গিতে কথা বলছে! সাদিয়া এখানে এলো কি করে! তবে সাদিয়া হলে এতোক্ষণে রাহাতকে চিনে ফেলার কথা। রাহাত পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারলোনা। সে কোনরকমে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা কি কখনো চিটাগং এ ছিলেন?

মেয়েটি এবার সত্যি যেন আকাশ থেকে পড়লো। এবার সে রাহাতের দিকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ালো। আশ্চর্য্য হওয়ার মতো করে সুন্দর একটি হাসি দিয়ে বললো, ওয়াও! আপনি জানলেন কি করে!

মেয়েটির হাসি দেখে রাহাত আরো আশ্চর্য্য হয়ে গেলো। সাদিয়া যখন হাসতো ওর গালে ঠিক এরকম একটি টোল পড়তো, সামনের পাটির ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো ঠোটের ফাঁক গলে ঠিক এমনিভাবে মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করতো। শুধু চিবুকের ওই তিলটার কারণে রাহাত এখনো নিশ্চিত হতে পারছেনা। কেননা সাদিয়ার মুখাবয়বে কোন তিল ছিলোনা। আচ্ছা সাদিয়া সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য কালো রঙ দিয়ে এই তিলটা এঁকে নেয়নি তো? যা দিনকাল পড়েছে এটা একেবারে অসম্ভব নয়। আজকাল অনেক মেয়েই সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য হাত-পায়ের নখে প্লাস্টিকের নকল নখ লাগায়। সাদিয়াও সে রকম কিছু এঁকে নেয়নি তো চিবুকে! রাহাত কোনরকমে সামলে নিয়ে বলে, আচ্ছা, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, আপনার মানে তোমার নাম সাদিয়া?

এবার ওপাশের মেয়েটির মুখ কালো হয়ে যায়। রাহাত লক্ষ্য করে মেয়েটার চোখ খানিকটা ছলছল করে ওঠে। মেয়েটি উড়নার কোণা খুটতে খুটতে বলে, না, আমার নাম নাদিয়া।

রাহাত ভীষণ আশাহত হয়। সে ভেবেছিলো, সে আবার তার সাদিয়াকে ফিরে পেয়েছে। একই পৃথিবীতে বসবাসরত দুজন মানুষের মধ্যে এতোটা মিল কীভাবে হয়! সাদিয়া ইচ্ছে করে নিজের পরিচয় গোপন করছে না তো? অবশ্য সাদিয়া হলে অন্যরকম রি-এক্ট করার সম্ভাবনা ছিলো। রাহাত বিমর্ষ বদনে বলে, ঠিক আছে। আমি ভেবেছিলাম আপনি সাদিয়া। প্লীজ ফরগিভ মি। আপনাকে শুধু শুধু এতোক্ষণ ডিস্টার্ব করলাম। বলেই রাহাত সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়িতে পা দেয়া মাত্রই নাদিয়া বেশ জোরে ডাক দিলো, শুনুন।
রাহাত আবার রেলিং পর্যন্ত এগিয়ে যায়। নাদিয়া বলে, আমি মনে হয় এখন আপনাকে চিনতে পারছি। আপনার পুরো নাম নিশ্চয় রাহাত-আল-মামুন?
রাহাত পুরোপুরি চমকে যায়। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, যাক বাবা সাদিয়া এতোক্ষণে তাহলে নিজের খোলস থেকে বের হতে শুরু করেছে। মূহুর্ত্বেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রাহাতের সমস্ত মুখমণ্ডল। সে স্বহাস্যে বলে এইতো চিনেছো!

নাদিয়া গম্ভীরস্বরে বলে হ্যাঁ চিনেছি। তবে আপনি আমাকে যে ভাবছেন, আমি আসলে সে নই। আমি সাদিয়ার ছোটবোন নাদিয়া।

এই কথা শোনার পরেও রাহাতের মুখে হাসিটা লেগে রয়। সাদিয়ার বোনকে যখন খুঁজে পাওয়া গেছে তখন সাদিয়াকেও নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া যাবে। রাহাত উচ্ছ্বাসের সাথে বলে, তাইতো বলি আপনি দেখতে কেন ঠিক সাদিয়ার মতো! আচ্ছা আপনারা কি যমজ?

হালকা হাসি দিয়ে নাদিয়া বলে, না আমরা যমজ নই। তবে আমি আর সাদিয়া আপু প্রায় পিঠাপিঠি। আমাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য মাত্র দেড় বছর। আমাদের দুজনের চেহারায় অনেক মিল। তাই অনেকেই আমাদের যমজ বলে ভুল করে। আমাদের দুজনের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো। আমরা কেউ কারো কাছে কোন বিষয় লুকোতাম না। আপনার কথাও আমি আপুর কাছ থেকে জেনেছি।

রাহাত উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, ছিলো মানে? এখন কি আপনাদের মধ্যে বন্ধুর মতো ভালো সম্পর্ক নেই?

নাদিয়া ধরা গলায় বলে, আপনি কিছু জানেন না! সত্যিই কিছু শুনেননি?

রাহাত ভয়ার্তস্বরে বলে, কি শুনবো? কি জানবো? কি হয়েছে সাদিয়ার? প্লীজ আমাকে সব খুলে বলুন। সেদিনের পর আমি ওকে অনেক খুঁজেছি। বাবার চিকিৎসা শেষে ভারত থেকে এসে সাদিয়াকে আর খুঁজে পাইনি। আপনার বাবা বদলি হয়ে রাজশাহী চলে গিয়েছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও আপনাদের রাজশাহীর কোন ঠিকানা খুঁজে পাইনি। তারপর মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম এই ভেবে যে আমি আবার একদিন আমার সাদিয়াকে ফিরে পাবো।

নাদিয়া বলে, প্লীজ উত্তেজিত হবেননা। বাবার বদলির কারণে আমরা রাজশাহী চলে গিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু আপু সবসময়ই আপনাকে মনে রেখেছিলো। প্রায় প্রত্যেক রাতেই ঘুম ভেঙ্গে দেখতাম আপু আপনার জন্য কাঁদছে। সান্ত্বনা দিতে গেলে ছোট বাচ্চাদের মতো আরো বেশী হাউমাউ করে কাঁদতো। আপনার তখন মোবাইল ছিলোনা। আপনার বাসার ফোন নাম্বারও আপু জানতো না। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ও আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। তাছাড়া রাজশাহী থেকে চিটাগং অনেক দূর। আমাদের পরিবার অনেক কনজারভেটিভ মাইন্ডের তাই আপুর পক্ষে একা একা এতোদূর যাওয়া সম্ভব ছিলোনা।

রাহাত উত্তেজিত হয়ে বলে, সব বুঝলাম। কিন্তু সাদিয়া এখন কোথায়? আর এই বাসাটাই বা কার?
নাদিয়া বলে, এই বাসা আমার এক কাজিনের। একটা ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য আমি এখানে এসেছি।
রাহাত মাথা নাড়ে এবং পুনরায় জিজ্ঞেস করে, বলুন না সাদিয়া এখন কোথায়?

অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর নাদিয়া বলে, সাদিয়া আপু আর বেঁচে নেই।

মেঘহীন কুয়াশাময় সকালেও একটি বাজ যেন বিকট শব্দ করে রাহাতের মাথায় আঘাত হানলো। সারা মাথা ঝুড়ে ঝি-ঝি শব্দ করতে লাগলো। এই কথাটি শোনার জন্য রাহাত মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। তার মুখের সব ভাষা যেন হারিয়ে গেছে কোন এক জলোচ্ছ্বাসে। অনেক কষ্টে সে বলতে পারলো, কি বলছেন এইসব?

নাদিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, যা বলছি সব সত্য। চট্টগ্রাম থেকে চলে আসার পর সাদিয়া আপু সবসময় বিমর্ষ হয়ে থাকতো। একদিন ঘোষণা করলো সে আর পড়াশোনা করবেনা। বাসার সবাই তো হতবাক, সাদিয়া আপুর মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টের মুখে এ কী কথা! শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন পরীক্ষা দেওয়ানো হলো। পরীক্ষা দিয়ে চান্সও পেয়ে গেলো। ভর্তি হলো ইকোনমিকসে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়মিত ক্লাস করতে লাগলো। তারপর একদিন ওদের ডিপার্টমেন্টের সবাই শিক্ষাসফরে গেলো সিলেট। পুরো সিলেট বেশ মজা করেই ওরা ঘুরে বেড়ালো। যেদিন ফিরে আসবে ঠিক তার আগের দিন সবাই বেড়াতে গেলো মাধবকুণ্ড। মাসটা সম্ভবত জুন-জুলাই ছিলো। ভরা বর্ষার মৌসুম হওয়ায় মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের জলের ধারা ছিলো পূর্ণ যৌবনবতী। প্রবল বেগে অবিরাম পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচে। পানির প্রবল শব্দে আশপাশের কারো কথা পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিলোনা। পানির নাচনে সবার রক্তেও যেন নাচন দিয়ে গেলো। সবাই সাঁতরাতে লাগলো কূপে। শেষবিকেলের দিকে সবাই জল থেকে উঠে এলো। হঠাৎ আপুর একজন বান্ধবী আবিষ্কার করলো সাদিয়া আপু নেই। সবাই ভাবলো আপু মনে হয় আগেই উঠে গেছে। তারপর আশপাশ সব জায়গা খুঁজাখুঁজি করেও যখন সাদিয়া আপুর দেখা মিললোনা তখন সবাই নিশ্চিত হলো আপু পানিতে তলিয়ে গেছে। সাথে সাথেই ডুবুরী জলপ্রপাতের নিচ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আপুর হদিশ পেলনা। পরদিন ভোরে ভেসে উঠলো আপুর লাশ। সবাই একে দুর্ঘটনা ভাবলেও আমি নিশ্চিত এ ছিল আত্নহত্যা। চট্টগ্রাম থেকে আসার পর মাঝে অনেকদিন চলে গেলেও আপু আপনাকে একটুও ভুলতে পারেনি। আপনাকে আপু কতোটুকু ভালোবাসতো তা মনে হয় আপনি নিজেও জানেন না। আমার ধারণা আপনাকে পাবেনা জেনেই সে আত্নহত্যা করেছে।

রাহাত যেন পুরোপুরি পাথর হয়ে গেছে। তার মুখ দিয়ে কোন রা বের হচ্ছেনা। দাঁড়ানো অবস্থাতেই খানিক সময়ের জন্য সে যেন সেন্সলেস হয়ে গেলো। ঝি-ঝি শব্দটা আরো তীব্র হয়ে, আরো তীক্ষ্ণ হয়ে বারবার কর্ণকোটরে আঘাত হানতে লাগলো। তার বারবার মনে পড়ছে সাদিয়ার সাথে প্রথম দেখার সেই ক্ষণটি, মনে পড়ছে ফয়েজ লেকে প্রথম চুম্বনের সেই স্মরণীয় মূহুর্ত্বটি। বারবার মনে পড়ছে সাদিয়ার সেই কথাটি, “ আমি যখন থাকবোনা, তখন বুঝবে কি ছিলাম আমি! ” এ কথা বললেই রাহাত ভীষণ রাগ করতো। আজ সেই অপ্রিয় কথাটিকে সত্য করে সাদিয়া দূরে চলে গেছে। আজ কার ওপর রাগ করবে রাহাত? সাদিয়া এতোদিন দূরে ছিলো ঠিকই কিন্তু সে যে এতোটা দূরে চলে গেছে তা কল্পনা করতে এখনো কষ্ট হচ্ছে রাহাতের। রাহাত ভেবেছিলো সাদিয়া হয়তো কারও ঘরনী হয়ে সুখে-শান্তিতে রয়েছে। তারপরও এই সান্ত্বনা ছিলো সাদিয়া এই পৃথিবীতেই তো আছে। প্রথম চুম্বনের ক্ষণে মৃদু আপত্তির সুরে সাদিয়া লেক থেকে দু-হাত ভরে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছিলো রাহাতকে। আজও সাদিয়া দুহাত ভরে পানি নাড়ছে, ছিটিয়ে দিচ্ছে। তবে সেই পানি শরীরে না লেগে টপটপ করে পড়ছে রাহাতের চোখ বেয়ে। ব্যর্থ হৃদয়ে সিক্ত প্রণয়ের অবিরাম বর্ষণে মূর্চ্ছা যায় রাহাত।

About রিপন ঘোষ

আমি এক অতি সাধারণ ছেলে। ভালো লাগে স্বপ্ন দেখতে। আর ভালো লাগে প্রাণ খুলে হাসতে। পদার্থবিদ্যায় স্নাতক করছি। সাহিত্যের প্রতি আমার এক বিশেষ দূর্বলতা আছে। তাই তো মাঝেমাঝে হাতে কলম তুলে নেই কিছু লিখতে। পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ক ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি করতেও ভালো লাগে। স্বপ্ন দেখি একজন পরিপূর্ণ ভালো মানুষ হওয়ার।

পাঠ প্রতিক্রিয়া জানান